রাজশাহীতে জন্ম নিবন্ধনের ভুল সংশোনে অর্থ আদায়ের অভিযোগ

মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী, বগুড়া নিউজলাইভ ডটকম: রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সরদাহ ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধনের ভুল সংশোধন করতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। জন্ম নিবন্ধনে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
জানা গেছে, ঘটনাটি প্রায় দশ থেকে পনের দিন আগের। সরদহ ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধন করতে গেলে এক সেবাগ্রহীতা সেখানে অনিয়ম দেখতে পান। একারণে তিনি গোপনে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করেন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে এসম্পর্কে অভিযোগ করেন। পরে তাতেও কোন পরিবর্তন না হওয়ায় তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের ভিডিওটি প্রদান করেন। এরপর জন্ম নিবন্ধনের জন্য অতিরিক্ত টাকার দাবি করা ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাইরাল হয়ে যায়। এতে স্থানীয় মহলে বেশ আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার প্রতিটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি কম্পিউটার, প্রিন্টার ও স্ক্যানার প্রদান করা হয়েছে এবং সেখানে একজন কম্পিউটার জ্ঞান সম্পন্ন প্রশিক্ষিত যুবককে ইউনিয়নে উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের কাজ হচ্ছে জন্মনিবন্ধনে আসা ব্যক্তিদের কাগজপত্রাদি নিয়ে তা বিনা খরচে নিবন্ধন প্রক্রিয়া করে দিবেন। তবে কোথাও কোন মেইল পাঠানো, প্রিন্ট কিংবা কম্পোজ করলে তাতে আলাদা সামান্য অর্থ নিতে পারবেন। এর বাইরে সেই উদ্যোক্তা কোন টাকা নিতে পারবেন না। অর্থাৎ ফ্রি জন্ম নিবন্ধনসহ ইউনিয়নের অন্যান্য কাজ করে দিবেন। কিন্তু কম্পোজ, প্রিন্ট বা মেইল পাঠানো বাবদ ব্যক্তিগত কাজে টাকা নিতে পারবেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, রাজশাহীর সরদহ ইউনিয়নের কর্মরত উদ্যোক্তা নাহিদ পারভেজ তুষার জন্ম নিবন্ধনের কাগজাদি জমা নেওয়ার সাথে সাথে টাকা দাবি করছেন। ভিডিওতে তাকে বলতে দেখা যাচ্ছে, ‘এটা কবে দিবো ঠিক নাই। দুই মাসও লাগতে পারে, দুই বছরও লাগতে পারে। শর্তে রাজি থাকলে কাগজপত্র দিয়ে যান। সাথে চারশ টাকা দেন।’
সেখানে ভুক্তভোগীকে বলতে শোনা যায়, ‘দুই মাসও লাগতে পারে ঠিক আছে, কিন্তু দুই বছর লাগলে কিভাবে হবে। কিভাবে কাজ হবে।’ তারপর উদ্যোক্তা তুষার আবার বলেন, ‘দুই মাসও লাগতে পারে, দুই বছরও লাগতে পারে। শর্তে রাজি থাকলে কাগজপত্র দিয়ে যান। সাথে চারশ টাকা দেন।’
ইউনিয়ন পর্যায়ে এমন অতিরিক্ত অর্থ দাবির কারণে বেকায়দায় পড়েছেন সরদহ ইউনিয়নের বাসিন্দারা। অথচ জানা গেছে, জন্ম নিবন্ধনের জন্য সরদহ ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলার মডেল ইউনিয়ন এটি। সেখানে সনদ দিতে সরকারি ফির আট থেকে দশ গুন টাকা আদায় করা হচ্ছে। এক রকম বাধ্য হয়েই টাকা দিচ্ছেন সনদ নিতে অভিভাবকরা।
এরপরও সেখানকার উদ্যোক্তার বক্তব্য, জন্মসনদ পেতে দুই বছরও লাগতে পারে। বেপরোয়া অর্থ আদায় ও ইচ্ছে করে সময় ক্ষেপণের কারণে সেবা নিতে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। টাকার কারণেই অনেক অভিভাবক এখনো জন্ম সনদ সংশোধন করাতে পারেননি।
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে খোজ নিয়ে জানা গেছে, জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য ১০০ টাকা ও জন্ম তারিখ ব্যতীত পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সংশোধনের পর সনদের কপি বিনা ফি তে সরবরাহের কথাও বলা হয়েছে।
সরেজমিন উপজেলার সরদহ ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, জন্মসনদ পেতে প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিলে চারশ থেকে পাচশ টাকাও দাবি করছেন সেখানকার উদ্যোক্তা। কিছু টাকা কম দিতে চাইলে আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি জন্মসনদ পেতে দুই বছর লাগবে মর্মে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সেখানে সেবা নিতে আসা ওই ইউনিয়নের কলেজছাত্র সজীব ইসলাম অভিযোগ করে বলে, ‘আমার বাবা-মা এবং আমার জন্ম সনদ সংশোধনের জন্য সরদহ ইউনিয়ন পরিষদে এসেছিলাম। ইংরেজি সংশোধনের জন্য তারা আমার কাছ থেকে ৬০০ টাকা নিয়েছে। এ ছাড়া বাবা-মায়ের নাম ও জন্মতারিখের দুই জায়গায় ভুল থাকায় আরও ৩০০ টাকা নিয়েছে।’
ওই ইউনিয়নের বিলকিস বেগমও করেছেন একই অভিযোগ। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়েদের স্কুলের জন্য চারটি জন্ম সনদ সংশোধন করেছি। তারা আমার কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে মোট ১ হাজার ২০০ টাকা নিয়েছে। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত আবেদন জমা নেয়নি। এ রকম টাকার দাবি করলে ইউনিয়নে সেবা নিতে আসা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় সরদহ ইউনিয়নের উদ্যোক্তা নাহিদ পারভেজ তুষারের সাথে। টাকার নেওয়ার পরও জন্ম সনদ পেতে দুই বছর লাগবে এমন উক্তির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তার ভাষ্য, ‘আমি ফাজলামি করে এক বন্ধুকে বিষয়টি বলেছিলাম। সেটাই হয়তোবা কেউ গোপনে ভিডিও করে ফেলেছে, বুঝতে পারিনি। তবে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না।’
অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সরদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান মধু বলেন, ‘এবিষয়টি আমি একেবারেই জানি না। কেউ আমাকে অভিযোগও দেয়নি। আপাতত আমি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত আছি। নির্বাচন শেষ হোক তারপর তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ব্যপারে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা সামিরা বলেন, ওই উদ্যোক্তার কথা বলার আচরণ ও ধরন কোনটায় ভালো না। এমনকি সে ওই উক্তিটি করার মতো তার কর্তৃত্বও নেই। বিষয়টি জানার পর আমি তাকে ডেকে কড়াভাবে শাসন করেছি। এর বেশি কিছু করার এখতিয়ারও আমার নেই।
এবিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে রাজশাহীর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক শাহানা আখতার জাহান প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি এখন ঢাকায় একটি সেমিনারে আছি। মিটিং শেষে কথা হবে।’
উল্লেখ্য, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইউনিক আইডি ও স্টুডেন্ট প্রোফাইল তৈরির জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তথ্য চেয়েছে সরকার। এসব তথ্যের মধ্যে শিক্ষার্থী ও তার পিতা-মাতার ইংরেজি ও বাংলা জন্ম নিবন্ধন সনদও চাওয়া হয়েছে। একারণে জন্ম সনদের ত্রুটি সমাধানের জন্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এখন শহরের ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পরিষদের শ^রণাপন্ন। আর এই সুযোগে অতিরিক্ত ইচ্ছেমতো অর্থ আদায় করে যাচ্ছে রাজশাহীর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ। এতে অভিভাবকরা রয়েছেন চরম হয়রানি ও পেরেশানিতে।

error

Share this news to your community