বগুড়ার পোড়াদহ মেলায় নারী পুরুষের পদচারনায় মূখরিত

বগুড়া নিউজলাইভ ডটকমঃ বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় উপচেপড়া নারী পুরুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল। মাঘ মাসের শেষ বুধবারে মেলা বসার কথা থাকলেও আগের ২/৩ দিন থেকেই মেলা শুরু হয়। মেলার আশ পাশের গ্রাম গুলোতে মেয়ে মেয়ের জামাই ও আত্মীয় স্বজনদের আসা শুরু হয়। প্রায় সপ্তাহব্যাপী মেলার আমেজ থাকে। পোড়াদহ মেলা মূলত “সন্যাসির মেলা দিয়ে শুরু হয়ে পোড়াদহ মেলা কালের বিবর্তনে এখন বলা হয় মাছের মেলা”। স্থানীয়রা বলেন, জামাই মেয়ে মেলা। বুধবার অনুষ্ঠিত হয় বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। মেলায় এবার সবচেয়ে বড় বাঘাইড় মাছের ওজন ছিল ৭০ কেজি। মেলার সব্বোর্চ এ মাছের দাম হাকা হয়েছে ১৮০০ টাকা কেজি দাম হাকা হয়েছে। এককভাবে মাছটির ক্রেতা না থাকায় শেষ পর্যন্ত মাছটি কেটে ১৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। এতে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা মূল্য পেয়েছেন বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম। এছাড়াও যমুনা নদী থেকে আনা ৬৫. ৪২ ও ৩৪ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ কেটে বিক্রি হয়েছে ১২’শ থেকে ১৬’শ টাকা কেজি দরে। সিরাজগঞ্জ সদরের মাছ ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম যমুনা নদী থেকে ৬৫ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মেলায় বিক্রি করেছেন। তিনিও একই দামে বিক্রি করছেন বলে জানালেন।
এছাড়াও মেলায় বোয়াল মাছের দাম প্রতি কেজি ১৫শ টাকা, নদীর বড়বড় কাতলা ১হাজার টাকা কেজি, আইড় মাছ ১৪ ’শ থেকে ১৫’শ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রুই বিক্রি হচ্ছে ৭’শ টাকা কেজি, চিতল ১২’শ টাকা থেকে ১৪ টাকা কেজি, নদীর পাঙ্গাস ১হাজার টাকা কেজি, ব্রিগেড ৬শ’ টাকা কেজি, ব্লাডকাপ ৭’শ টাকা কেজি, বড় সিলভার কাপ ৪.৫০’শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য জাতের মাছও মেলায় উঠেছে। তবে মাছের রাজা ইলিশ মেলায় উঠে নাই। মেলার জন্য ১০ কেজি ওজনের মাছ আকৃতির মিষ্টি তৈরী করেছেন বিশিষ্ট মিষ্টি ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ। মহিষাবান এলাকার মিষ্টি ব্যবসায়ী বাদশা এবার ১ হাজার মন মিষ্টি মেলায় তুলেছেন। ভাল মিষ্টির দাম হাকানো হয়েছে ৪ টাকা কেজি। এছাড়াও মেলায় মাছ, মিষ্টি, গরুর মাংস, বড়ই (কুল), কাঠ ও ষ্টীলের ফার্নিচার, কস্মেটিকসহ বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী হাট-বাজারের মতোই ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে যা চোখে পড়ার মতো। মেলায় লাখো মানুষের পদচারণ হয়েছে।
মেলার প্রথম দিন জামাই বরণ এবং দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার বউমেলার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যাবে ঐহিত্যবাহি পোড়াদহমেলা।

জানা যায়, বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নে ইছামতি নদীর শাখা (খাল) সংলগ্ন পোড়াদহ নামক স্থানে বসে এই মেলা। প্রায় দেড়শতাধিক বছর আগে বগুড়া-চন্দনবাইশা সড়ক সংলগ্ন পোড়াদহ খালের পাড়ে এক বিশাল বটবৃক্ষ তলে আয়োজন করা হতো সন্যাসী পূজার। প্রতি বছরের মাঘ মাসের শেষ বুধবার আয়োজিত এই মেলা কালের বিবর্তনে হয়ে ওঠে পূর্ব বগুড়াবাসীর মিলনমেলা। পোড়াদহ নামক স্থানে হয় বলে এ মেলার নাম হয়ে যায় পোড়াদহ মেলা। মেলাকে ঘিরে আশপাশে প্রায় ২০ গ্রামের মানুষ মেয়ে ও মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। তাদের সাথে নিমন্ত্রণ দিয়ে থাকে স্বজনদের। এ কারণে স্থানীয়রা আবার এ মেলাকে জামাই মেয়ে বলে থাকে। নদী তীরবর্তী স্থানে এই মেলায় দিন দিন নানা প্রজাতির মাছের আমদানি হতে থাকে। এক সময় তা এই অঞ্চলে মাছের মেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইছামতীর খালের পশ্চিমপাশের খোলা মাঠে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে এই মেলায়। মেলায় আসা মাছ বিক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের বড় মাছ বিক্রির প্রতিযোগিতা লেগে যায়। যে যত বড় মাছ মেলায় তুলতে পারবে তত তার নাম ডাক। মাছ বিক্রেতাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে মিষ্টি বিক্রেতারাও। গত কয়েক বছরে তাদের মধ্যে এ প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।
এছাড়াও গাবতলী থানা সদরে কাজী বাজারে, দূর্গাহাটা হাইস্কুল মাঠ, বাইগুনী ও সুবাদবাজারে মাছ-মিষ্টির মেলা বসেছিল। উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দর সংলগ্ন পোড়াদহ নামক স্থানে প্রায় ৪’শ বছর পূর্বে থেকে স্থানীয় সন্ন্যাাসী পূজা উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও স্থান পরিবর্তন করে গোলাবাড়ী বন্দরের পূর্বধারে সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানা জমিতে একদিনের জন্য মেলা বসে। মেলাটি একদিনের হলেও তিনদিন পর্যন্ত চলে। প্রতিবছর বাংলা সনের মাঘ মাসের শেষ বুধবার মেলাটি হয়। মেলা উপলক্ষে পার্শ¦বর্তী উপজেলাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন শ্রেনীর মেলায় দেখা গেছে। এ ব্যাপারে মেলার পরিচালক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলাকে ঘিরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মেলায় মেয়ে-জামাই, আত্মীয় স্বজনসহ লাখো মানুষের পদচারণা মুখরিত হয়ে উঠেছিল গোটা এলাকায়। মেলায় শিশুদের জন্য বিনোদনমূলক বিচিত্র গান, নাগোরদোলা, চরকি এবং মটরসাইকেল খেলা ছিল। গাবতলী মডেল থানার ওসি সাবের আহমেদ রেজা বলেন, পোড়াদহ মেলাটি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেলা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে প্রতিবছরের মতো আজ গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়নের রানীরপাড়া গ্রামে বউমেলা অনুষ্ঠিত হবে।
মেলা উপলক্ষে পার্শ্ববর্তী অন্তত ২০ গ্রাম আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
এ মেলায় মাছ, মিষ্টি, ফর্নিচার, বড়ই, পান শুপারী, তৈজস পত্র, খেলনা থাকলেও কালক্রমে মাছের জন্য বিখ্যাত হয়ে আসছে। মেলাকে ঘিরে প্রায় ২০ গ্রামের মানুষ স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে থাকে। বিশেষ করে মেয়ে ও মেয়ে জামাইকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি চলে আনন্দ উৎসব। মেলায় যেমন মাছের আকর্ষন তেমনি বাড়ি বাড়ি জামাই আকর্ষণ। কোন জামাই কত বড় মাছ কিনেছে তা নিয়েও চলে প্রতিযোগিতা। জামাইরা একে অন্যের বাড়ি বেড়াতে যায় মিষ্টি হাতে। আবার জামাইদের হাতে বাড়ির বড়রা নগদ অর্থ তুলে দিয়ে থাকে। সবাই সবার জন্য কেনা কাটা করে থাকে। বৃহস্পতিবার একই স্থানে বসবে বউমেলা। এ মেলায় বাড়ির গৃহিনী বা মহিলাদের জন্য আয়োজন হয়ে থাকে। পোড়াদহ মেলার প্রথম দিনে পুরুষদের ভীড়ের জন্য মহিলা মেলায় যেতে পারে না। এ কারণে পরের দিন মহিলাদের জন্য অনুষ্ঠিত হয় বউমেলা। এবার মেলার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন মহিষাবান ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, হাজার হাজার মানুষের পদচারণা হয়ে থাকে এ মেলায়। আশপাশের ২০ গ্রামের মানুষের কাছে ঈদের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। মেলাকে কেন্দ্র করে জামাই ও মেয়েসহ আত্মীয় স্বজনদের দাওয়া দেয়া হয়ে থাকে।
গাবতলী উপজেলাসহ পাশ্ববর্তী সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, ধুনট, বগুড়া শহরের লাখো মানুষের পদচারনা হয় মেলায়। এছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে মেলায় লোকজন আসে। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। মেলাকে কেন্দ্র করে জামাই ও মেয়েসহ আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেয়া হয়ে থাকে। প্রতিটি ঘর হয়ে উঠে উৎসবমূখর। মেলা পরিদর্শনে গিয়ে ছিলেন বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মেলার কয়েকদিন আগে থেকেই বিক্রেতারা ভিড় করতে থাকে। একারণে থানা অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

error

Share this news to your community