শতকরা ১৮% পাম্পে তেল চুরির প্রমাণ!

অভিযান চালিয়ে ঢাকায় বেশ কয়েকটি ফিলিং স্টেশনে পরিমাণে কম জ্বালানি তেল দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন, বিএসটিআই।
গত ১৫ দিনে ১৮টি স্টেশনে পেট্রোল ও অকটেন পরিমাপে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে এই সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, যন্ত্রে কারসাজি করে ভোক্তাদের পরিমাপে কম দেওয়ার কাজটিতে ফিলিং স্টেশনের মালিকরাই জড়িত। তবে মালিক সমিতির নেতা দাবি করেছেন, হাতেগোনা কয়েকটি ফিলিং স্টেশনেই এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, অন্যরা সততার সঙ্গে ব্যবসা করছেন।

গত ৫ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিভাগের অন্তত ১০০টি পেট্রোল পাম্পে পরিমাপ পরীক্ষা করে বিএসটিআই। এর মধ্যে অন্তত ১৮টি পাম্পে ওজনে কারচুপির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বিএসটিআইএর সার্ভিল্যান্স দলের প্রধান রেজাউল করিম। তিনি বলেন, এর অধিকাংশই ঢাকা মহানগরের অভ্যন্তরে। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের পাশাপাশি ১২টির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

গত ১৬ অক্টোবর মিরপুরের শাহআলীবাগ এলাকায় মেসার্স স্যাম এসোসিয়েটসে বড় ধরনের কারচুপির প্রমাণ পায় বিএসটিআই। পরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলার পাশাপাশি এটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। স্যাম এসোসিয়েটসের ৪টি ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৫৪০ মিলিলিটার, ৫৩০ মিলিলিটার, ৫২০ মিলিলিটার ও ৫০০ মিলিলিটার তেল কম দেওয়া হচ্ছিল। দুটি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৪৪০ মিলিলিটার ও ৪১০ মিলিলিটার করে অকটেন কম দেওয়া হচ্ছিল। দুটি পেট্রোল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৪৬০ মিলিলিটার ও ৪৭০ মিলিলিটার করে পেট্রোল কম দেওয়া হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন গড়ে আনুমানিক ৩৬ হাজার লিটার পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল বিক্রি করে থাকে।

একই দিন উত্তরার আজমপুর এলাকার মেসার্স কসমো ফিলিং স্টেশনে দুটি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ১৪০ মিলিলিটার হারে অকটেন ও চারটি ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ১৫০ মিলিলিটার, ১২০ মিলিলিটার, ১৯০ মিলিলিটার ও ২০০ মিলিলিটার হারে ডিজেল কম দেওয়ার প্রমাণ পায় বিএসটিআই।

উত্তরার তুরাগ এলাকার মেসার্স লতিফ অ্যান্ড কোং ফিলিং স্টেশন অকটেন ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৩১০ মিলিলিটার এবং দুটি ডিজেল ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ১৬০ মিলিলিটার ও ১৭০ মিলিলিটার তেল কম দেওয়া হচ্ছিল।

মঙ্গলবারও বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিমাপে কারচুপির জন্য তেজগাঁও, আমিন বাজার ও গাবতলী এলাকায় তিনটি পেট্রোল পাম্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাদেরকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে।

তেজগাঁওয়ের মেসার্স সততা অ্যান্ড কোংয়ে একটি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারের মধ্যে ৬০ মিলিলিটার তেল কম পাওয়া যায়। এছাড়া দুটি ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৭০ ও ৬০ মিলিলিটার হারে কম তেল দেওয়া হচ্ছিল।

আমিন বাজার এলাকার মেসার্স চিশতিয়া ফিলিং স্টেশনে তিনটি ডিজেল ও একটি অকটেন আন্ডার গ্রাউন্ড স্টোরেজ ট্যাংকের হালনাগাদ ক্যালিব্রেশন চার্ট পাওয়া যায়নি।

আর গাবতলীতে মেসার্স নূর ডিজেল পাম্প ফিলিং স্টেশন নন স্ট্যান্ডার্ড/নন ম্যাট্রিক ক্যালিব্রেশন চার্ট ব্যবহার করছিল।

এর আগে গত ২০ অক্টোবর মিরপুরের মেসার্স রহমান সার্ভিস স্টেশনে দুটি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৯০ মিলিলিটার ও ১১০ মিলিলিটার কম দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এছাড়া মেসার্স আল মোসাফির ভেরিফিকেশন সনদ গ্রহণ ব্যতীত ডিজিটাল স্কেল ব্যবহার করছিল।

গত ২১ অক্টোবর উত্তরা ও গাজীপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়।

উত্তরা আব্দুল্লাপুর এলাকার মেসার্স তাসিন সিএনজি ফিলিং স্টেশন একটি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৫০ মিলিলিটার কম তেল দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

গাজীপুর এলাকার মেসার্স স্টার ফিলিং স্টেশন পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৪০ মিলিলিটার, ৫০ মিলিলিটার ও ৫০ মিলিলিটার হারে কম তেল দেওয়ার প্রমাণ মেলে।

এই দুটিসহ গাজীপুর এলাকার মোট চারটি পেট্রোল পাম্পের ‍বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে মামলা করা হয়।

বিএসটিআইএর সার্ভিল্যান্স দলের প্রধান রেজাউল করিম বলেন, পেট্রোল পাম্পগুলোতে এই কারচুপি মালিকের গোচরেই ঘটছে। “এগুলো অবশ্যই পাম্প মালিকরা ইচ্ছে করেই করছেন। অটো মেশিনগুলোকে টেম্পারিং করতে সময় লাগে এক থেকে দেড় মিনিট। অনেকগুলো আছে রিমোট কনট্রোলড। সেগুলোতে চুরি করা খুবই সহজ।” তিনি বলেন, “ধরুন আপনি দীর্ঘক্ষণ ধরে ৫০ মিলিলিটার হারে কম দিচ্ছেন। আবার একটি বাটন আছে, সেখানে টিপ দিলেই সঠিক অবস্থানে চলে আসছে। ডিজিটাল মেশিনগুলোতে এই চুরি করা যাচ্ছে সহজেই।”

বিএসটিআই কর্মকর্তারা বলেন, বাতাসে সহজে মিশ্রণপ্রবণ পেট্রোল-অকটেন প্রতি ১০ লিটারে ৩০ মিলিলিটার কম হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর চেয়ে কম বেশি হলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। বিএসটিআইএর সার্ভিল্যান্স দলের প্রধান রেজাউল করিম বলেন, “বেশিরভাগ পাম্পে সঠিক মাত্রা পাওয়া গেলেও যেসব পাম্পে অনিয়ম পাওয়া গেছে, সেটাও উদ্বেগের বিষয়। আমরা এধরনের অভিযান অব্যাহত রাখবো। একটি পাম্পে এক মাসে একাধিক অভিযানও চালানো হবে।”

‘সবাই নয়’

বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশেনের মহাসচিব মিজানুর রহমান বলেন, পেট্রোল অকটেনের প্রতি লরিতে ৫০ থেকে ৬০ লিটার তেল কমে যায়। সে কারণে পাম্প মালিকরা লিটারে ৫০ মিলিলিটার কম দিয়ে সেটা সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। তবে বিএসটিআইয়ের নিয়মে ৩০ মিলিলিটার কম-বেশি করার সুযোগ রয়েছে। বিএসটিআইর অভিযানে কিছু ফিলিং স্টেশনে অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরা হলে একে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“এটা খুবই অন্যায়। এতে একদিকে যেমন অপরাধ সংগঠিত হয়, অন্যদিকে ক্রেতাদের মাঝে পাম্পের দুর্নাম হয়। ভালোভাবে ব্যবসা করতে চাইলে চুরি ছাড়াও লাভজনক ব্যবসা করা যায়।”

নর্থ বেঙ্গল ফিলিং স্টেশনের মালিক মিজান বলেন, “যেসব পাম্প চুরিদারি করে, তা হাতেগোনা কয়েকটি। অধিকাংশ পেট্রোল পাম্পই সততার সঙ্গে ব্যবসা করছে।

error

Share this news to your community