খেলাপি ঋণসংস্কৃতি

ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠন করতে বাধা কোথায়?

দেশে খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা এ কথা সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করলেও ঋণের পরিমাণ কত, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। বেসরকারি হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকা। অথচ সরকারের দাবি, এই ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে না। যখন ঋণের পরিমাণ নিয়ে হিসাবের লুকোচুরি চলে, তখন সমস্যার সমাধান আশা করা যায় কীভাবে?

গত শনিবার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা এই প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে সংকট উত্তরণে তাঁরা কিছু সুপারিশও করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ব্যাংকিং খাতের জন্য ন্যায়পাল নিয়োগ, মন্দ ঋণ আদায়ের জন্য ‘ডেট রিকভারি বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ গঠন, অর্থঋণ আদালতে কোনো রায় হলে সরাসরি সম্পত্তি জব্দ করার সুযোগ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাতিল, ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রদান, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের সঙ্গে অন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা । ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সমস্যা অনেক পুরোনো। সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও এই সমস্যার কথা অস্বীকার করছেন না। খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার নানা সময়ে ঋণখেলাপিদের অন্যায্য সুবিধাও দিয়েছে। কিন্তু সেসব কোনো কাজে আসেনি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে গরম কথা বললেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্দেশ্যে ঋণগ্রহীতাদের নানা রকম ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু কথায় বলে ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’। খেলাপি ঋণের হোতারা এতটাই শক্তিশালী যে অর্থমন্ত্রীর এসব সদুপদেশ আদৌ আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। বরং উদ্বেগের খবর হলো, খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

পৃথিবীর সব দেশেই ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই ব্যাংকিং খাতই যদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে বাধ্য, যার আলামত নানাভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ কারণে গোলটেবিল বৈঠকের কোনো কোনো বক্তা ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযানের কথা উল্লেখ করে ব্যাংকিং খাতেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন। একজন ব্যাংকার বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য থাকলেও ঋণখেলাপিদের তোষণের বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। এ কারণে ঋণখেলাপিরা সব সরকারের আমলেই নিরাপদ থাকেন।

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি উপেক্ষা করে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় গঠন করা হয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। গোলটেবিল বৈঠকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকারী অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম কয়েকটি সরকারি ব্যাংক একীভূত করার সুপারিশ করেছেন। কিন্তু অর্থনীতির আকারের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যাও অনেক বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সে ক্ষেত্রে সরকারি খাত থেকে অর্থ দিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে না রেখে একীভূত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা সংকট উত্তরণে একটি শক্তিশালী ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা সময়োপযোগী। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা সত্ত্বেও কেন এত দিন হয়নি, বাধা কোথায়—সেটাই প্রশ্ন। সূত্র: প্রথম আলো।

error

Share this news to your community