আম্পানের আঘাতে বিদ্ধস্ত উপকূল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি

বগুড়া নিউজলাইভ ডটম ডেস্কঃ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের হানায় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। বুধবার (২০ মে) বিকেল থেকে এটি স্থলভাগে উঠে আসতে শুরু করে। সন্ধ্যা নাগাদ মূল আঘাত আসে সুন্দরবনে এ সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। প্রবল বেগের এই ঝড়ে উপকূলীয় এলাকায় বিধ্বস্ত হয় ঘরবাড়ি, ভেঙে পড়ে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। গাছ ও দেয়াল চাপা পড়ে নারী-শিশুসহ অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে; যা আরও বাড়তে পারে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আম্পানের হানায় উপকূলের ১৯ জেলায় অন্তত ৫১ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে। গাছ ও দেয়ালচাপায় এবং নৌকাডুবিতে বিভিন্ন স্থানে ১০ জনের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রাত সোয়া ১২টার দিকে আম্পান ১৩৫ কিলোমিটার বেগে যশোর অতিক্রম উত্তর দিকে অগ্রসর হয়।
আম্পান সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চালিয়েছে সাতক্ষীরায়। উপকূলীয় এ জেলায় রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঝড়ের গতিবেগ ছিল ১৪৮ কিলোমিটার। আম্পানের মূল কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গ হয়ে অতিক্রম করতে শুরু করে। এ সময় সাতক্ষীরা, খুলনাসহ পশ্চিম উপকূলে ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়। রাত ১০টার দিকে জোয়ার শুরু হলে ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে প্লাবিত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রবল ঝড়ে গাছচাপায় সাতক্ষীরা শহরে গৃহবধূ, যশোরে ঘুমন্ত অবস্থায় মা-মেয়ে, পটুয়াখালীতে শিশুসহ দুজন, কলাপাড়ায় নৌকাডুবিতে একজন, পিরোজপুরে দেয়ালচাপায় একজন, ভোলার চরফ্যাসনে গাছচাপায় একজন, বরগুনায় একজন এবং লক্ষ্মীপুরে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, সকালে আম্পান রাজশাহী অঞ্চল হয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়টির গতি এখন অনেক কমে গেছে। এটি আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তবে আজ সারাদিনই আবহাওয়া বৈরী থাকতে পারে।
সুন্দরবনে প্রথম আঘাত আসায় তা ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। উপকূলীয় জনপদে জীবন ও সম্পদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ভেঙে পড়েছে, বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে অনেক বাঁধ। গাছপালা উপড়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই উপকূলীয় এলাকার ৫১ লাখের মতো গ্রাহক বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আম্পানের প্রভাবে তাদের উপকূলীয় ২২টি সমিতিতে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটেছে। এতে পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও বরিশালের কিছু অংশসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় ৫০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ওজোপাডিকো) লাখখানেক গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছেন।
গতকাল সকাল থেকে মহাদুর্যোগের হুমকি নিয়ে এগিয়ে আসছিল আম্পান। সুপার সাইক্লোন থেকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিলেও এর অগ্রভাগ উপকূল স্পর্শ করার সময় ঝড়ের গতি ছিল তীব্র। ওড়িশা এবং সাগরদ্বীপে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ার পর এর বিধ্বংসী শক্তি কিছুটা কমে যায়। পশ্চিমবঙ্গের স্থলভাগে আম্পানের অগ্রভাগ প্রবেশ করে বিকেল ৩টায়। আরও এক ঘণ্টা পরে এটি সুন্দরবন হয়ে সাতক্ষীরা উপকূল স্পর্শ করে। পশ্চিমবঙ্গে এ পর্যন্ত ১০-১২ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।
এদিকে, আম্পানের সার্বিক পরিস্থিতি গণভবনে বসে পর্যবেক্ষণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার থেকে উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। গতকাল দুপুরের মধ্যে প্রায় ২৪ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয় বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়। ফলে মোট আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭৮টি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলার অসংখ্য স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। ভেঙে গেছে কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালা। মূল ঝড় আসার আগে থেকেই দুপুর ১২টার পর দাকোপ উপজেলার ৩১ নম্বর পোল্ডারের খলিশা, পানখালী, কাঁকড়াবুনিয়া, কামিনিবাসিয়া, বটবুনিয়া গ্রামের বেড়িবাঁধ উপচে গ্রামের ভেতরে পানি প্রবেশ শুরু করে।
বরিশাল কলাপাড়ায় সতর্কীকরণ প্রচারণা চালাতে গিয়ে নদীতে নৌকা ডুবে শাহ আলম মীর (৫৫) নামের এক স্বেচ্ছাসেবক নিখোঁজ রয়েছেন। হিজলায় মঙ্গলবার গভীর রাতে মেঘনায় দুই ট্রলারের সংঘর্ষে নিখোঁজের ১২ ঘণ্টা পর ট্রলার মাঝি রাসেল হাওলাদারের মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন স্থানীয়রা।
ভোলায় ঝড়ে গাছ পড়ে চরফ্যাসনের কচ্চপিয়ায় সিদ্দিক ফকির নামের ৭০ বছরের একজন মারা গেছেন। দিনভর টানা দমকা হাওয়া আর থেমে থেমে বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সাগর মোহনার ঢালচর, চর কুকরীমুকরী, চর নিজাম, কলাতলীর চরসহ নদীর মধ্যবর্তী ২০টি চর।
সাতক্ষীরায় জোরালো দমকা হাওয়ার সঙ্গে নদ-নদীর পানি আছড়ে পড়ছিল বেড়িবাঁধের ওপর। শ্যামনগরে সহস্রাধিক কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত এবং বহু গাছপালা উপড়ে গেছে। অনেক সড়কে গাছ পড়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এ সময় ওই এলাকার নাপিতখালী, নেবুবুনিয়া, দুর্গাবাটি, ঘোলা বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বলেশ্বরের চার-পাঁচ ফুট পানি বেড়ে মাঝের চরের বেড়িবাঁধের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের দেড়শ ফুট বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে চরের ৪০-৫০ একর জমির বিভিন্ন ধরনের সবজি তলিয়ে গেছে। পটুয়াখালীতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার ফুট বেড়ে উপকূলীয় রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া, গরুভাঙা, চর আন্ডা, মাঝের চর ও খালগোড়া এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দশমিনা উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায় তেঁতুলিয়া নদী-তীরবর্তী বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এ ছাড়া স্বাভাবিকের থেকে তেঁতুলিয়া ও বুড়া গৌরাঙ্গ নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।
বাগেরহাট সদরসহ মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও মোংলা উপজেলার বেশ কিছু জায়গা প্লাবিত হয়েছে। বরগুনায় তিনটি নদীর (পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর) পানি বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের শত শত ঘরবাড়ি। য়াখালীতে অস্বাভাবিক জোয়ারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার চারটি ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

error

Share this news to your community