লঞ্চে আগুন, ৪১ লাশ উদ্ধার, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, দগ্ধ ও আহত শতাধিক

বগুড়া নিউজলাইভ ডটকম ডেস্কঃ ঝালকাঠি লঞ্চঘাট থেকে এক-দেড় কিলোমিটার সুগন্ধা নদীর মাঝ পথ। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীবাহী ‘অভিযান-১০’ লঞ্চের গন্তব্য ছিল বরগুনা। ভোর ৩টায় কিছু যাত্রী ও লঞ্চের স্টাফ ছাড়া অধিকাংশই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘন কুয়াশায় লঞ্চ এগিয়ে চলছে আপন গন্তব্যে। ভোরে ঘাটে ভিড়তেই যাত্রীরা ফিরবে যে যার বাড়িতে। এমন অপেক্ষার মধ্যে বিকট শব্দে লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে, পরে গোটা লঞ্চ জ্বলে উঠে আগুনে। সুগন্ধার অথৈই পানির মাঝ নদীতে লঞ্চের এ আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুনে দগ্ধ হয়ে ও হুড়োহুড়িতে হতাহত হয় পেছনে থাকা ডেকের শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। নিখোঁজ রয়েছেন তিন শতাধিক যাত্রী যাদের সন্ধান মিলেনি শুক্রবার রাত পর্যন্ত।

ভয়াবহ আগুনের পর সুগন্ধার তীরে এখন পোড়া লাশের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। স্বজনদের আহাজাড়িতে ভারি হয়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, ঝালকাঠি ও বরগুনার প্রত্যন্ত অঞ্চল। বাড়িতে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। আগুনের ভয়াবহতার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোট লঞ্চে। বাড়ি ফেরা মানুষগুলোর এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না স্বজনরা। আগুনে জীবন্ধ পুড়ে অঙ্গার হওয়া নারী-পুরুষ ও শিশুদের স্বজনদের আহাজারি সুগন্ধা নদীর পাড় ছড়িয়ে বরিশাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটেও।

এদিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতহাতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। উদ্ধার কাজে ফায়ার সার্ভিস ছাড়ও অংশ নিয়েছে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশ, র‌্যাব, স্থানীয় পুলিশসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আগুন লাগা ও হাতাহাতের ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যু এবং শত যাত্রী দগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তির খবর মিললেও নিখোঁজ ৩০০ জনের কোন খোঁজ মিলছে না।

বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা বলেছেন, তিনতলা ওই লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সময় হাজারখানেক যাত্রী ছিল। ঝালকাঠির গাবখানের কাছাকাছি সুগন্ধা নদীতে থাকা অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত ৩টার পর লঞ্চে আগুন ধরে যায়। পরে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের দিয়াকুল এলাকায় নদীর তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে জ্বলতে থাকা ওই লঞ্চ থেকে প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন যাত্রীদের অনেকে। স্থানীয়রা ভিড় করেন নদীতীরে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরাও ছুটে আসেন। ট্রলার নিয়ে লঞ্চের আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন তারা।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, রাত ৩টা ২৮মিনিটে তাদের কাছে অগ্নিকাণ্ডের খবর আসে। তাদের কর্মীরা ৩টা ৫০ মিনিটে সেখানে পৌঁছে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। অগ্নিনির্বাপণের অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিটের চেষ্টায় ভোর ৫টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। স্থানীয় বাসিন্দা, কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ সদস্যরাও উদ্ধার অভিযানে সহযোগিতা করেন।

ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, যেখানে লঞ্চটিতে আগুন লেগেছে, ওই এলাকা ঝালকাঠি লঞ্চঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের অংশটি বেশি পুড়েছে। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা।

নৌ-পুলিশের বরিশাল জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চটিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠির কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ শুরু করে। এখন পর্যন্ত লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৪১ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। দগ্ধদের মধ্যে ৭২ জনকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।

ওই লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী আবদুর রহিম জানান, রাতে ডেক থেকে তিনি হঠাৎ বিকট শব্দ পান। তারপর লঞ্চের পেছন দিক থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে দেখেন। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন দেখে আতঙ্কিত হয়ে তিনি ডেক থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তখন অধিকাংশ যাত্রী ঘুমে ছিলেন। তিনি নদীতে লাফিয়ে পড়ার পর দিয়াকুল গ্রামের লোকজন নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিচ্ছিলেন। তারাই রহিমকে উদ্ধার করে গরম কাপড় দেন। পরে সকালে তাকে ট্রলারে করে ঝলাকাঠি শহরে নেয়া হয়।

বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৮১ জন দগ্ধ রোগীকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। রোগীদের নারী ও পুরুষ সার্জারি বিভাগ এবং শিশুদের শিশু সার্জারি বিভাগে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। যারা ৮০ ভাগের ওপর দগ্ধ হয়েছেন তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ১০ জন দগ্ধ রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দুপুর পৌনে ১টার দিকে অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারজিয়া আক্তার নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় হাসপাতালের ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) সাতজনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

কত যাত্রী ছিলেন হিসাব মিলছে না
ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চটি আয়তনে অনেক বড় হলেও লঞ্চটিতে যাত্রী ধারণক্ষমতা কত আর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লঞ্চটি কত যাত্রী নিয়ে ঢাকা ছেড়েছে তার সঠিক হিসাব মিলছে না। বিআইডব্লিটিএর সদরঘাটের কর্মকর্তাদের হিসাবে লঞ্চটি সাড়ে ৪০০ যাত্রী নিয়ে ঘাট ছাড়লেও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, যাত্রীর সংখ্যা সাড়ে ৩০০ ছিল।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আমাদের হিসাবমতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পুড়ে যাওয়া লঞ্চে ৩৫০ জনের মতো যাত্রী ছিল। এর বেশি থাকলে তদন্ত করে দেখা হবে। এ ছাড়া লঞ্চের ফিটনেস ঠিক ছিল বলে জানতে পেরেছি।

তবে ঢাকার সদরঘাটে কর্মরত বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক দিনেশ কুমার সাহা জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। চাঁদপুর ও বরিশাল টার্মিনাল লঞ্চটি থামে এবং যাত্রী উঠা-নামা করে। এরপর ঝালকাঠি ঘাটও করে। ছোট ছোট ঘাট ধরে লঞ্চলটি বরগুনায় সেখানার যাত্রীদের নামায়।

অন্যদিকে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য, লঞ্চটিতে হাজারখানেক যাত্রী ছিল। সুগন্ধা নদীতে থাকা অবস্থায় লঞ্চটিতে আগুন লাগে। পরে পার্শ্ববর্তী দিয়াকুল এলাকায় লঞ্চটি ভেড়ানো হয়। তখন লঞ্চটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। রাত ৩টার দিকে লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। পরে যাত্রীরা প্রাণে বাঁচতে অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেন।

লঞ্চের মালিক জামাল শেখ টেলিফোনে জানিয়েছেন, লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ৮০০। শুক্রবার লঞ্চলিতে পাঁচ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঢাকার ঘাট ছাড়ে। লঞ্চটি চাঁদপুরের পর বরগুনার বেতাগী, বামনা, কালকিনি, রামান, ফুলঝড়ি এবং কাকচির ঘাট করার পর বরগুনায় শেষ গন্তব্য ছিল।

অথৈই পানির সুগন্ধা নদীতে দাউ দাউ করে জ্বলছিল অভিযান-১০
অভিযান ১০ লঞ্চে আগুন লাগলেও সুগন্ধা নদীর অথৈই পানি ব্যবহার করে আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়েছে লঞ্চের স্টাফরা। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও তা কাজে আসেনি। এ নিয়েও উঠেছে নানা কথা। লঞ্চটিতে যখন আগুন লাগে তখন নদীর পানি ব্যবহার করারও সুযোগ ছিল। কিন্তু লঞ্চ স্টাফদের অদক্ষতা আর যাত্রীদের আতঙ্কিত হয়ে পড়ার কারণে আগুনে এত বড় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা।

লঞ্চ মালিকের ভাষ্য অনুযায়ী, লঞ্চটিতে ২১টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ছিল। আগুন লাগার পর এর কোনটিই কাজে লাগানো যায়নি। নৌ-পুলিশের তথ্য বলছে, লঞ্চের ইঞ্চিনরুম থেকে আগুন লাগে। আগুন লাগার পর এক ঘণ্টা ধরে লঞ্চটি চলছিল। তখন ইঞ্চিন রুমে লোক থাকলে আগুন এত ছড়িয়ে পড়ত না।

যাত্রীদের ভাষ্য, লঞ্চটি প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে জ্বলছিল। নদীর মাঝে থাকলেও কেউ পানি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেনি। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে গোটা লঞ্চ শ্মশানে পরিণত হ।

যেভাবে আগুন লাগে
শুক্রবার সন্ধ্যার পর লঞ্চটি হাজারের বেশি যাত্রী নিয়ে সদরঘাট ছাড়ে। লঞ্চটি সকালেই বরগুনায় ঘাট করার কথা। লঞ্চটিতে ঝালকাঠি, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকার যাত্রী ছিল। লঞ্চের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় যাত্রীদের অধিকাংশ নিম্নআয়ের মানুষ। সেখানে অনেকেই বিছানা পেতে আসন নিয়েছেন। নারী, পুরুষ ছাড়াও লঞ্চটিতে শিশুও ছিল। লঞ্চটি ঝালকাঠি লঞ্চঘাটের আগে এক কিলোমিটার মাঝ নদীর মধ্যে আগুন লাগে। এরপর চোখের সামনেই পুরো লঞ্চটি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। সামনে কেবিনে থাকা যাত্রীদের অধিকাংশই লাফিয়ে পড়লেও পেছনে থাকা যাত্রীদের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন দগ্ধ হয়। পরে আগুন নেভানোর পর একে একে উদ্ধার হতে থাকে পোড়া লাশ।

বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া অভিযান-১০ লঞ্চ যাত্রী নিয়ে বরগুনা যাচ্ছিল। লঞ্চটি ঝালকাঠি ঘাটে ভেড়ানোর আগেই বিকট শব্দে আগুন লেগে যায় পিছনের দিকে। যাত্রীরা ধারণা করছেন, ইঞ্জিন রুমে কোন ক্রটির কারণেই আগুন লেগেছে। ওই সময় লঞ্চের যাত্রীদের অধিকাংশই ঘুমে ছিলেন।

লঞ্চ মালিক হাম জালাল শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চের কেরানি আনোয়ার ভোর রাত ৩টার ৫মিনিটে তাকে ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। ‘সে বলেছে দোতলায় একটা বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন দেখা যায়। তারপর তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন।’

ওই লঞ্চে অন্তত ২১টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ছিল, কিন্তু এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে যে সময় পাওয়া পায়নি। একটি পাইপ গেছে ইঞ্জিন থেকে, সেখানে প্রথম বিস্ফোরণ হয় বলে আনোয়ার তাকে জানিয়েছে।

ওই লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী আবদুর রহিম জানান, রাতে ডেক থেকে তিনি হঠাৎ বিকট শব্দ পান। তারপর লঞ্চের পেছন দিক থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে দেখেন। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন পুরো লঞ্চ গ্রাস করে ফেলে। আতঙ্কিত হয়ে তিনি ডেক থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন।

বেচে ফেরা আরেক যাত্রী আবদুর রব জানান, ঢাকা থেকে লঞ্চটি ছাড়ার সময়ই ইঞ্চিনে ক্রটি ছিল। রাত ৩টায় ঝালকাঠি জেলার গ্যাবখান চ্যানেল অতিক্রম করার সময় ইঞ্চিনে ত্রুটি দেখা হয়। লঞ্চের ইঞ্জিন মাস্টার তখন ইঞ্জিন ঠিক করছিল। এর পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যেই আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে আগুন লাগে।

আগুন লাগার পরও লঞ্চ চলছিল
এদিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ‘অভিযান-১০’ লঞ্চে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পরও এক ঘণ্টা ধরে লঞ্চটি চলছিল বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ঝালকাঠি থেকে মাঝে দুটি স্টপেজ থাকলেও লঞ্চটি থামানো হয়নি।

নৌ-পুলিশের কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, অগ্নিদগ্ধ লঞ্চটির হাসপাতালে আহত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ইঞ্জিন রুমের অপারেটর ইঞ্জিন রুমে ছিলেন না অথবা আগুন লাগার পর তিনি পালিয়ে গেছেন। রাত প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে লঞ্চটি যখন নলছিটি ক্রস করে তখন এর ইঞ্জিনে আগুন লাগে। কিন্তু লঞ্চটি নলছিটিতে স্টপেজ দেয়নি, এমনকি ঝালকাঠিতেও স্টপেজ দেয়নি। ‘ইঞ্জিন রুমের উপরে থাকেন লঞ্চের সারেং। ইঞ্জিন অপারেটর নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত সারেং লঞ্চ থামাবেন না অথবা ঘাটে ভেড়াবেন না। ধারণা করা হচ্ছে, লঞ্চের সারেং প্রথমে আগুন লাগার খবর জানতে পারেননি। এ কারণে আগুন লাগার এক ঘণ্টা ধরেও লঞ্চ চলতে থাকে।’

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নৌপুলিশ এ ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত শুরু করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত বা যাদের অবহেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সর্বোচ্চ আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।

তদন্ত কমিটি গঠন
বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বন্দর ও পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. সাইফুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল হাসান বাদল এবং ঝালকাঠির ডিসি মো. জোহর আলী সকালে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেছেন।

নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একজন যুগ্মসচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে কোন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে কি-না, তা এখনই বলতে পারছি না।

উদ্ধার কাজে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, নৌ-পুলিশ
এদিকে অগ্নিদুর্ঘটনার পর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমডি অভিযান-১০ লঞ্চে হতাহতদের উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে র‌্যাব। উদ্ধার কার্যক্রম পরিদর্শনে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ-আল মামুন। র‌্যাব জানিয়েছে, সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে র‌্যাব। উদ্ধার কার্যক্রম পরিদর্শনে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

দগ্ধদের হাসপাতালে পাঠানোসহ নদীতে সম্ভাব্য নিখোঁজদের তল্লাশিতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

কোস্টগার্ড জানিয়েছে, আগুন দুর্ঘটনার পর কোস্টগার্ড উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা লঞ্চ থেকে ৯ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার করেছে। আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছে। নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য তৎপড়তা চালাচ্ছে।

নিখোঁজ যাত্রীদের হদিস মিলছে না
আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, লঞ্চটির ৩ শতাধিক যাত্রীর খোঁজ মিলছে না। যাত্রীদের হিসাবে লঞ্চটিতে এক হাজার যাত্রী থাকার কথা জানা গেলেও লঞ্চমালিক পক্ষের দাবি লঞ্চটি পাঁচ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঘাট ছেড়েছে। লঞ্চে আগুন লাগার পর ৩৯ জন লঞ্চে জীবন্ধ দগ্ধ হয়ে মারা গেলেও আহত অবস্থায় পরে আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো দগ্ধ ৮১ জনের মধ্যে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন অনেকই। তবে নদীতে লাফিয়ে পড়া যাত্রীদের অনেকের খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে অনেকে নদীতে ডুবে মারা গেছেন। এখন লাশ ভেসে উঠলে হয়তো বুঝা যাবে দুর্ঘটনায় কত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।

এদিকে শুক্রবার সন্ধায় পুড়ে ছাই হওয়া ৩৯ জনের লাশ নিয়ে ঝালকাঠি থেকে বরগুনায় নিয়ে গেছেন জেলা প্রশাসকের টিম। পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরের পর যেসব লাশের কোন স্বজন মিলবে না তাদের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হবে ডিএনএ নমুনা রেখে।

error

Share this news to your community