মহিলাদের চেহারা : পর্দার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক

উম্মে লুবা মোছাঃ সালমা হকঃ পর্দা ইসলামী শরীয়াতের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। কুরআন ও সুন্নাহতে পর্দার প্রতি জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। পর্দা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।
পর্দার ক্ষেত্রে পুরূষগন হাটু থেকে নাভী পর্যন্ত (নাভীসহ) ঢেকে রাখবে আর মহিলারা তাদের গোটা শরীর ঢেকে রাখবে। মহিলাদের শরীরের সবটুকুই হাদীসের ভাষায় ‘আওরাহ’ বা পর্দা। এটাই চার মাযহাবের পরবর্তী ফকীহগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এটা বললে হয়ত কোন অতুক্তি হবে না যে, ফিতনার আশংকায় মহিলাদের মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের নিচ পর্যন্ত গোটা শরীর পর্দার অর্ন্তভুক্ত হওয়ার বিষয়ে চার মাযহাবের মুতাআখখিরীন ফকীহগণ একমত। তবে এ বিষয়ে পূর্বসূরী কিছু কিছু ফকীহগণের ভিন্নমতও পাওয়া যায়। তাদের অনেকে মহিলাদের হাত এবং চেহারাকে পর্দার অর্ন্তভুক্ত করেন নি। কিছু শর্ত সাপেক্ষে চেহারা এবং হাত খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের এ ভিন্নমতে শ্রদ্ধা রেখে যুগ এবং বাস্তবতার চাহিদায় পরবর্তী ফকীহগণ পর্দার ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করেছেন। এখানে আমরা শুধুমাত্র মহিলাদের চেহারার পর্দার বিষয়ে কুরআন, হাদীস এবং তাফসীর ও ফিকহ থেকে আলোচনা করব। ইংশা-আল্লাহ

কুরআন কারীমের নির্দেশনা
এক. আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ. وَكَانَ اللَّـهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
অর্থ: হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব : ৫৯)

আয়াতের আংশিক তাফসীর:-
এ আয়াতে মহিলাদেরকে ‘জিলবাব’ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। ‘জিলবাব’ বলা হয় এমন প্রশস্ত কাপড়কে যা মাথায় রাখা হয়। নিচের দিকে ছেড়ে দিলে তা মুখমন্ডলকে আবৃত করে।
ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন, ‘জিলবাব’ বলা হয় মাথার এমন কাপড়কে যা পুরো শরীরকে আবৃত করে। এ আয়াতকে দলীল উপস্থাপন করে অধিকাংশ মুফাসসির বলেন, আয়াতে চেহারা আবৃত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন,
” أمر الله نساء المؤمنين إذا خرجن من بيوتهن في حاجة أن يغطين وجوههن من فوق رؤوسهن بالجلابيب ويبدين عيناً واحدة
অনুবাদ:- আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে।-(ফাতহুল বারী ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪, তাফসীর ইবনু কাসীর)
ইমাম ইবনু সীরীন বলেন, আমি (বিখ্যাত তাবেয়ী) উবাইদা আস সালমানীকে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, কাপড় দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করবে এবং এক চোখ খোলা রাখবে।
ইমাম নাসাফী (র.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তারা চাদর তাদের উপর টেনে দিবে, যাতে ইহা দ্বারা তারা তাদের চেহারা আবৃত করে। (মাদারিকুত তানযীল, ৩/৭৯)

আয়াতের সারাংশ: বুঝা গেলো অধিকাংশ মুফাসসিররের মতে উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে চেহারা ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

দুই. আল্লাহ তাআলার বাণী-وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ
অর্থ : এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে। (সূরা নূর : ৩১)
আয়াতের আংশিক তাফসীর:-
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (র.) স্বীয় বুখারী শরীফের কিতাবুত তাফসীরে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন,
يرحم الله نساء المهاجرات الأول، لما أنزل الله : وليضربن بخمرهن على جيوبهن شققن مورطهن فاختمرن بها.

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি রহম করুন। কেননা আল্লাহ তাআলা যখন وليضربن بخمرهن على جيوبهن
আয়াত নাযিল করলেন তখন তারা নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করেছিলেন।-(সহীহ বুখারী ২/৭০০)
হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. এর হাদীস থেকে জানা গেল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই মুসলিম রমনীগণ চাদর ছিড়ে ছিড়ে নিজেদের পর্দা করতেন।
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী র. এ হাদীসের বক্তব্যকে আরো স্পষ্ট করেছেন এভাবে যে,‘ফাখতামারনা’ (তারা আবৃত করতেন) এর অর্থ হলো- তারা মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।-(ফাতহুল বারী ৮/৩৫৭)
ইমাম বদরুদ্দীন আইনী হানাফী (র.)ও ‘ফাখতামারনা বিহা’ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যে চাদর তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তা দিয়ে নিজেদের মুখমন্ডল আবৃত করলেন। (উমদাতুল কারী ১৯/৯২)

আয়াতের সারাংশ : এ আয়াতের ব্যাখ্যা থেকে জানা গেল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই মুসলিম নারীগণ তাদের চেহারা ঢেকে রাখতেন।

হাদীস শরীফের নির্দেশনা
এক. বুখারী শরীফে কিতাবুত তাফসীরে ইফকের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এ দীর্ঘ হাদীসের একটি অংশ হলো, হযরত আয়শা রা. বলেন-
وكان صفوان بن المعطل السلمي ثم الذكواني من وراء الجيش فأدلج فأصبح عند منزلي فرأى سواد إنسان نائم فأتاني فعرفني حين رآني ، وكان يراني قبل الحجاب فاستيقظت باسترجاعه حين عرفني فخمرت وجهي بجلبابي.

অনুবাদ:- সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিলেন বাহিনীর পিছনে আগমনকারী। তিনি যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌছলেন তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেলন। এরপর তিনি আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেললেন। কারণ পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। তিনি তখন ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলে উঠলেন, যার কারনে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি।
(বুখারী, হাদীস নং-৪৫৬৫)

হাদীসাংশের সারাংশ : হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. এর বর্ণনা থেকে বুঝা গেল পর্দার বিধান নাযিলের পূর্বে মহিলাগণ চেহারা খোলা রাখার অবকাশ ছিল। কিন্তু পর্দার বিধান নাযিলের পর তারা চেহারা ঢেকে রাখতেন।

দুই. হযরত আসমা বিনতে আবি বাকর রা. বলেন- كُنَّا نُغَطِّيَ وُجُوهَنَا مِنَ الرِّجَالِ
অর্থ :, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত করে রাখতাম (মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪) হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ।

তিন. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تنتقب المرأة المحرمة ولا تلبس القفازين
অর্থ : ইহরাম বেধেছে এমন নারী যেন নেকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৮৩৮)

এ হাদীস থেকে বুঝা যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়েও মহিলাদের নেকাব পড়ার বিধান ছিল। ইহরাম অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলো পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। আবার হযরত আয়শা রা. এর হাদীসে পাওয়া যায়, মহিলা সাহাবীগণ প্রয়োজনের তাকীদে ইহরাম অবস্থায়ও চেহারা ঢেকে রেখেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. বলেন-
كان الركبان يمرون بنا ونحن محرمات مع الرسول صلى الله عليه وسلم فإذا حاذونا سدلت إحدانا جلبابها على وجهها من رأسها فإذا جوزنا كشفنا

অনুবাদ : আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তারা যখন আমাদের সামনাসামনি চলে আসত তখন আমাদের সকলেই চেহারার ওপর জিলবাব টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে আবার তা সরিয়ে নিতাম। (মুসনাদে আহমাদ ৬/৩০; ইবনে মাজাহ,হাদীস: ২৯৩৫)

সারকথা : উপরোক্ত হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেও মহিলা সাহাবীগণ পর পুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখতেন না। তারা তাদের চেহারা ঢেকে রাখতেন।

উল্লেখ্য চার মাযহাবের অধিকাংশ আলেমের মতে মহিলাদের চেহারা পর্দার অর্ন্তভুক্ত। পরবর্তী যুগের কোন আলেম এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন নি। সে হিসাবে এ মাসআলায় পরবর্তী যুগের সকল আলেমের ইজমা তথা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সামান্য সংখ্যক আলেম এ বিষয়ে দ্বিমত করেছেন। উসূলে ফিকহ’র নিয়ম অনুযায়ী জমহুরের সিদ্বান্তের সাথে দ্বিমত পোষণকারী কিছু আলেম থাকলেও সেটা ধর্তব্য নয়। সর্বোপরি ফকীহগণ চেহারা আবৃত করা আবশ্যক হওয়ার জন্য যে ইল্লত তথা কারন পেশ করেছেন তা কোন আলেমই অস্বীকার করতে পারবেন না। এ ইল্লত হলো (ফিতনা), তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই কুরআন সুন্নাহর চিন্তবীদ ফকীহগণ পর পুরুষের সামনে মহিলাদের চেহারা আবৃত রাখার উপর একমত। এর বিরূধিতা করার অর্থ হলো সমাজে ফিতনা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের সহীহ বুঝ দান করুন । আমীন
লেখক: প্রধান শিক্ষিকা, তাহযীবুল বানাত মহিলা মাদরাসা,
নাটাইপাড়া, (এসপি ব্রিজ সংলগ্ন) বগুড়া।

error

Share this news to your community